1. muktokotha@gmail.com : Harunur Rashid : Harunur Rashid
  2. isaque@hotmail.co.uk : Harun :
  3. harunurrashid@hotmail.com : Muktokotha :
নিরবে চলে গেলো বাউল ঋষি, উদাস কবি, জমিদার হাসন রাজার জন্মদিন - মুক্তকথা
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২১ পূর্বাহ্ন

নিরবে চলে গেলো বাউল ঋষি, উদাস কবি, জমিদার হাসন রাজার জন্মদিন

হারুনূর রশীদ কর্তৃক সংগৃহীত
  • প্রকাশকাল : বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ১৩৬৩ পড়া হয়েছে

চারিদিকে কেমন একটা স্থবির ভাব। সবই ঠিকমত চলছে আবার যেনো চলছে না। এমন এক দু’টানায় যখন সারা বিশ্ব দুলছে তেমনি এক যুগসন্ধিক্ষনে আমাদের দোয়ার থেকে নিরবে ফিরে গেলেন এক ঋষি দরবেশ।

করোণা, ওমিক্রম! জৌলুশময় বিশ্বে দীপ্ত আলোর নিচের অন্ধকার। এক মহামারি হাহাকার!
আমিই বড়! মানুষের অহংকারী হুঙ্কার। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষেরই অস্ত্রবাজী, প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর মানুষকে হত্যা, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে মুসাফির বানিয়ে দেশান্তরীত হতে বাধ্য করা; এমনই যখন বিশ্বের অবস্থা, এমন সন্ত্রস্ত-বিক্ষুব্ধ অবস্থায় প্রায় নীরবেই চলে গেলো একটি তারিখ। ২১ ডিসেম্বর। এমনিতেইতো খুব ঘটা করে কিছু করা হয়ে উঠেনা। তার পরও যা কিছু হয় এবার তাও মনে হয় হয়ে উঠতে পারেনি। দিনটি ছিল সুফি সাধক, মরমী কবি, বাউল শিল্পী দেওয়ান হাছন রাজার জন্ম তারিখ। আমাদের দৈন্যতায় ফিরে গেলেন দুয়ারে দর্শনদিতে আসা ঋষি!

পূণ্যাত্মা এই স্বভাব কবির জন্ম হয়েছিল ১২৬১ বাংলা সনের ৭ পৌষ বা ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর, প্রাচীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত লক্ষণছিরি পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে। অহিদুর রেজা বা দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী এ দু’টি নামে তিনি পরিচিত ছিলেন তবে সমধিক পরিচিত নাম হলো হাছন রাজা। 
উইকিপিডিয়া লিখছে- “মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে।” বিশেষজ্ঞদের মতে লালন শাহ্‌ ছিলেন এর প্রধান পথিকৃৎ। তার পরই যে নামের উল্লেখ করতে হয় তিনিই হলেন দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। মরমী সাধক এই মহাপুরুষের পিতা ছিলেন সে সময়ের মহাপ্রতাপশালী জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী। হাছন ছিলেন তার ৩য় পুত্র। হাছন রাজার মায়ের নাম ছিল হুরমত জাহান বিবি। এই হুরমত জাহান বিবি ছিলেন দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরীর মাসিত্ব ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা স্ত্রী। এই হুরমত বিবির ঘর আলো করেই হাছন রাজার জন্ম হয়েছিল।


হাছনরাজার বাড়ী। ছবি: অন্তর্জাল

যতদূর জানা যায়, হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন সনাতনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদেরই একজন বাবু রায় চৌধুরী মতান্তরে বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামে তার পূর্ব পুরুষ বিজয় সিংহ বসতি শুরু করেন, পরে কোন একসময় বিজয় সিংহ কোণাউরা গ্রাম ত্যাগ করে একই এলাকায় নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তার বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ “রাম” যোগ করে নামকরণ করেন রামপাশা।

পুস্তক ও গণমাধ্যম ঘাটাঘাটি করে যতটুকু জানা গেছে তা হলো, ‘হাসন রাজা’ তার বাপ-মায়ের রাখা নাম নয়। এ নামটি রাখা হযেছিল, প্রাচীন সিলেটের ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লা বলে এক খ্যাতীমান ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শে। ওই নাজির আব্দুল্লাই এমন নামটি রাখার মত প্রকাশ করেছিলেন আর তাই নাম রাখা হয়েছিল ‘হাসন রাজা’। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন।

১৩৪৪ বাংলায় প্রকাশিত ঈদ সংখ্যা ‘হানাফী’ পত্রিকার ১৪ পৃষ্ঠায় একজন মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া হাছন রাজা বিষয়ে লেখেন- “বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো।”
হাছন রাজা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেছেন এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি ছিলেন পর্যবেক্ষন জ্ঞানে জ্ঞানী, দূরদর্শি একজন গুণী স্বশিক্ষিত পূণ্যবান মহাপুরুষতূল্য ব্যক্তিত্ব। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় সহস্রাধিক গান রচনা করে গেছেন।

 

উত্তারিধাকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। জীবন ও যৌবনের সূচনায় হাছন রাজা ছিলেন ভোগবিলাসী, শৌখিন আর অত্যাচারী জমিদার। রমণী সম্ভোগে তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন-
“সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া”।
প্রতিবছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় থাকার ব্যবস্থা করতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখতেন। তার সেই ভোগ-বিলাসিতার প্রধান আকর্ষণ থাকতো নারী ও সুরা। এসবের মধ্যে থেকেও তিনি প্রচুর গান রচনা করে গিয়েছেন। সেসময় তার এসব গান নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ গাওয়া হত। এ ছিল তার স্বভাব ধর্মের মত। আশ্চর্য ও বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখার বিষয় হল, এসব গানে জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে, ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেই নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। নারী আর নেশা নিয়ে মগ্ন অবস্থায় হাছন রাজার গান রচনা একমাত্র ইরাণের নন্দিত কবি হাফেজ সিরাজীর সাথে তুলনা করা যায়।
হাছন রাজা খুব অনন্দমনে ঘোড়া পুষতেন। ঘোড়া ছিল তার প্রিয় সহচর। তিনি পাখিও খুব ভালোবাসতেন। জানা যায়, ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। তার প্রিয় দুটি ঘোড়ার নামও জানার সুযোগ হয়েছে। একটির নাম ছিল ‘জং বাহাদুর’ অপরটি ছিল  ‘চান্দমুশকি’ বলে জানা যায়। এই ‘চান্দমুশকি’ শব্দের অর্থ বিষয়ে কিছু কারো কোন লেখায় পাওয়া যায়নি। হাসন রাজাকে নিয়ে যারা কিছুটা গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন তাদের লেখা থেকে হাছন রাজার মোট ৭৭টি ঘোড়ার নাম পাওয়া যায়।
হাছন রাজা যখন দাপটের সাথে জমিদারী চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিক এমনি সময়কালে এক রাতে এক স্বপ্ন-দর্শন হাছন রাজার জীবন দর্শনে নিয়ে আসে আমূল পরিবর্তন। সেই স্বপ্ন দেখার পর থেকে হাছন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে তার চরিত্রে আমূল পরিবর্তন দেখা দিতে লাগলো। বিলাসিতার জীবন তিনি ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলেন। শুধরাতে শুরু করলেন জীবনের ভুল ত্রুটিগুলো। শুধু বহির্জগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তার মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। স্রষ্টা প্রেম তাকে মোহময় করে তুলেছিল। বিরামহীনভাবে স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে লিখে যেতেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে থাকলো। চমৎকার মোহনীয় সুরের সেসব গানের একটি হলো-
“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।”

 


হাছনরাজা যাদুঘর। ছবি: অন্তর্জাল

এভাবে প্রকাশ পেতে লাগলো তার বৈরাগ্যভাব। হাছন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। ডাকসাইটে রাজা এককালে ‘চন্ড হাছন’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি হলেন পুরোটাই বিপরীত। এমনটাই বিপরীত যে তার এক গানে সেই আক্ষেপের হাহাকারধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে এ ভাবে-
“ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন
সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন।”

পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে ফকিরী-জীবন যাপন করেন। এক সময় তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়- হাসন এম.ই. হাই স্কুল থেকে শুরু করে অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান ও আখড়া। ১৯০৭ সালে তাঁর রচিত ২০৬টি গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আরো কিছু গান ‘হাসন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্‌’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে। তার বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ‘সৌখিন বাহার’ পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ। এই পুস্তকের আলোচ্য বিষয হল- ‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচারের বিষয়।
এ পর্যন্ত পাওয়া হাছন রাজার গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশী ছিল।

সুনামগঞ্জ জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘হাসন রাজার অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান কম গাওয়া হয়। ভাববাদ ও আধ্যাত্মিক গান বেশি চর্চা হয়। সবকিছুই গাইতে হবে, না হয় হাসন রাজাকে জানা হবে কম।’

হাসন রাজার প্রপৌত্র, হাসন রাজা মিউজিয়ামের পরিচালক সামারিন দেওয়ান বলেন, হাসন রাজাকে স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমির আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তিনি হাসন রাজাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানান।

জেলা কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী জানান, জানুয়ারিতে হাসন রাজাকে নিয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে উৎসব হবে। হাসন রাজার গান সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে শিল্পকলা কর্তৃপক্ষ। মরমি কবি হাসন রাজার ১৬৭তম জন্মদিন উপলক্ষে হাসন রাজা ফাউণ্ডেশনের উদ্যোগে আগামী ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিকেল সাড়ে চারটা থেকে হাসন উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এতে বর্তমান প্রজন্মের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জাহিদুল কবির, কামরুজ্জামান রাব্বি, বাউল গরিব মুক্তার, এস বি শাহীন, কানিজ খন্দকার মিতু, অনিকা আক্তার লিমা প্রমুখ সংগীত পরিবেশন করবেন।
পুস্তক ও অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত

 

এ জাতীয় সংবাদ

তারকা বিনোদন ২ গীতাঞ্জলী মিশ্র

বাংলা দেশের পাখী

বাংগালী জীবন ও মূল ধারার সংস্কৃতি

আসছে কিছু দেখতে থাকুন

© All rights reserved © 2021 muktokotha
Customized BY KINE IT